প্রবোধকুমার সাণ্যাল (১৯০৫-১৯৮৩) সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পরিব্রাজক। ১৯০৫ সালের ৭ জুলাই উত্তর কলকাতার চোরবাগানে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুরে এবং স্থায়ী নিবাস কলকাতার বালিগঞ্জে। তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম ‘কীর্তনীয়া’। চার বছর বয়সে পিতৃহীন হয়ে তিনি মাতুলালয়ে বাল্য ও কৈশোর অতিবাহিত করেন।
প্রবোধকুমার কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজিয়েট স্কুল ও সিটি কলেজে অধ্যয়ন করেন। কর্মজীবনে তিনি হুগলির ডাকবিভাগ ও সামরিক বিভাগের হিসাবরক্ষণ শাখায় চাকরি করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তিনি কিছুদিন পাবনার গ্রামে অন্তরীণ ছিলেন। তিনি যুগান্তর পত্রিকায় রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক (১৯৩৭-৪১) ছিলেন এবং স্বদেশ পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালে একবার রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।
প্রবোধকুমার দেশভ্রমণ পছন্দ করতেন। তিনি মানস সরোবর, কৈলাস পর্বত ও হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলসহ ছয়বার সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন। ভারতবর্ষ ও নেপাল ছাড়াও তিনি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়ার বহু অঞ্চল ভ্রমণ করেন। এসব ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মহাপ্রস্থানের পথে (১৯৩৭), রাশিয়ার ডায়েরী, দেবতাত্মা হিমালয় (২ খন্ড), উত্তর হিমালয় চরিত প্রভৃতি ভ্রমণকাহিনী রচনা করে বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। এগুলির মধ্যে প্রথমটি খুবই জনপ্রিয় গ্রন্থ। তিনি ১৯৬০ সালে কলকাতায় ‘হিমালয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং ১৯৬৮ সালে হিমালয়ান ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি নরওয়ের পথে উত্তরমেরু ভ্রমণ করেন।
প্রবোধকুমার দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে আগ্রায় এবং পরের বছর ব্রহ্মদেশে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তানে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং পরের বছর সোভিয়েট রাশিয়ার আমন্ত্রণে তাসখন্দে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় সাহিত্য সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।
কল্লোল যুগের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক হিসেবেই প্রবোধকুমারের প্রধান পরিচয়। তিনি সমকালীন বিজলী, কল্লোল, স্বদেশ, দুন্দুভি, পদাতিক, ফরওয়ার্ড, বাংলার কথা প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন এবং বিজলী, স্বদেশ ও পদাতিক পত্রিকা নিজেই সম্পাদনা করতেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস যাযাবর প্রকাশিত হয় ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। পরে তিনি প্রিয়বান্ধবী (১৯৩১), অগ্রগামী (১৯৩৬), অাঁকাবাঁকা (১৯৩৯), পুষ্পধনু (১৯৫৬), বিবাগী ভ্রমর, হাসুবানু, বনহংসী, কাঁচ কাটা হীরে, নিশিপদ্ম ইত্যাদি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ রচনা করেন। তিনি কথাসাহিত্যে নরনারীর দেহজ প্রেম অপেক্ষা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবিক সম্পর্কের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এভাবে তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে এক নতুন সমাজ নির্মাণের ইঙ্গিত দেন। একজন পর্যটকের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর উপন্যাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে; এজন্য তাঁর উপন্যাসে একক জীবন ও চরিত্র অপেক্ষা বিচিত্র জীবন ও চরিত্রের ভিড় লক্ষ করা যায়। বহুবর্ণিল জীবনকথা তিনি সরল অথচ হূদয়গ্রাহী ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।
প্রবোধকুমার তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক (১৯১১), শিশির কুমার পুরস্কার, মতিলাল পুরস্কার (১৯১০), শরৎ পুরস্কার এবং আনন্দ পুরস্কার (১৯৮০) লাভ করেন। ১৯৮৩ সালের ১৭ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়।